মোঃ বশিরুল আলম, আলমডাঙ্গা থেকে ॥ জমে উঠেছে দেশের সর্ববৃহৎ চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জ বাজারের ঐতিহ্যবাহী খেজুর গুড়ের হাট। প্রতিবছরের মতো এবারও ক্রেতা-বিক্রেতাদের আনাগানো শুরু হয়ে গেছে। গুড় কিনতে বিভিন্ন জেলা থেকে আসছেন বেপারিরা। সপ্তাহে সোমবার ও শুক্রবার বসে এ হাট। খেজুরগাছ থেকে সংগ্রহ করা রস দিয়ে তৈরি ঝোলাগুড় ও নলেন পাটালি বেচাকেনার জন্য এই হাটের ঐতিহ্য কয়েকশ’ বছরের। চুয়াডাঙ্গার সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের সরোজগঞ্জে চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ আঞ্চলিক মহাসড়ক ঘেঁষে স্থানীয় সরোজগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে এ হাটের অবস্থান। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে বেচাকেনা। প্রতি সপ্তাহে প্রায় কয়েক কোটি টাকার গুড় কেনাবেচা হয়।মাটির হাড়ি বা ভাঁড়ের আকার ও ওজন ভেদে দাম ওঠানামা করে। মান ভেদে একভাঁড় গুড় বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে শুরু করে ২ হাজার বা ২ হাজার ২ শত টাকা পর্যন্ত দাম চলছে। স্বাদে ও গন্ধে এখানকার গুড় অতুলনীয়। অন্যান্য বারের তুলনায় এখানকার খেজুর গুড়ের চাহিদা বেশি থাকায় দামও বাড়ছে।পুরো এলাকাজুড়ে সাজানো খেজুর গুড়ভর্তি মাটির ভাঁড় ও ছোট ছোট ধামা-কাঠায় নলেন পাটালি। ক্রেতা-বিক্রেতারা তা দাঁড়িয়ে দেখছেন। দরদাম ঠিক হলে ওজন করে ভর্তি করা হচ্ছে ট্রাক। আবার কেউ কেউ নিজের বাড়ি বা আত্মীয়ের বাড়ি পাঠানোর জন্য চাহিদা অনুযায়ী কিনছেন। হাটের প্রবেশপথের দু’ধারে বসে কৃষকেরা ধামা-কাঠায় করে তাদের বাড়িতে তৈরি পাটালি বিক্রি করছেন। পাটালির দোকান পার হয়ে ভেতরে যত যাওয়া যায়, বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ততই চোখে পড়ে সারি সারি সাজানো গুড়ের ভাঁড়। সেইসঙ্গে ক্রেতা-বিক্রেতা ও শ্রমিকদের কর্মযজ্ঞ। হাটের একাধিক স্থানে দাঁড়িপাল্লায় গুড় মেপে হাটে ভেড়ানো ট্রাকগুলোতে গুড়ের ভাঁড় তুলে সাজানো হয়। আগামী চৈত্র মাস পর্যন্ত চলবে বেচাকেনা।স্থানীয়রা জানান, প্রতিবছর শীত মৌসুমে সারাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেজুর গুড়ের বেচাকেনা হয় এ হাটে। স্বাদে ও গন্ধে এখানকার গুড় অতুলনীয়। মৌসুমের প্রায় পুরো সময়জুড়েই হাজারো ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে জমজমাট থাকে এই হাট। স্থানীয় পাইকার, মহাজন এবং বিভিন্ন মোকাম থেকে আসা ব্যাপারীরা এমনটাই দাবি করেন।দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গুড় কিনতে সরোজগঞ্জের হাটে আসেন ব্যাপারীরা। ঢাকা থেকে গুড় কিনতে এসেছেন জাহিদ হোসেন, তিনি জানান, দেশের অন্যান্য হাটে এখানকার চেয়ে কম দামে গুড় পাওয়া যায়। তবে, সেসব গুড়ে চিনি মেশানো থাকে বলে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা কেউ তা কেনেন না। বেশি দাম জেনেও ব্যাপারীরা ভালো গুড় কিনতে চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জেই ছুটে আসেন, ১২ থেকে ১৪ কেজি ওজনের একটি গুড়ের ভাঁড় ১,৫০০ থেকে ২,২০০ শত টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এ হাটে নিরাপত্তা সহকারে আমরা গুড় কিনতে পারি। ক্রেতা জহিরুদ্দিন বলেন, আমরা এই সরোজগঞ্জ বাজারে বহুদিন ধরে গুড় কিনে বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠিয়ে থাকি, যেমন ঢাকা, চট্রগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, পঞ্চগড়, দিনাজপুর, ফরিদপুর, টেকের হাটসহ বিদেশেও রপ্তানি করে থাকি, তবে এবার গুড়ের বাজার ভাল, গাছি বিলুপ্তি হয়ে যাচ্ছে কেননা পুরাতন গাছি যারা তারা অনেকেই মারা গেছে যুবক ছেলেরা নতুন গাছি হচ্ছে না তাই গাছি কুমে গেছে সে ক্ষেত্রে বাজারে গুড় কম আসতে শুরু করেছে। এবাজার থেকে প্রতি হাটে ১০ থেকে ১৫ টি ট্রাক লোড হয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যায়।সরোজগঞ্জ গুড়ের হাটে গুড় বিক্রি করতে আসা চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার নবীননগর গ্রামের গাছি জাহিদুল বলেন, আমি প্রায় ৪০টি গাছের রস সংগ্রহ করি, আমি ২০ বছর ধরে এই হাটে গুড় নিয়ে আসছি। আমাদের কাছ থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যাপারীরা গুড় কিনে নিয়ে যায়। তবে, গুড়ের ভাড়ের দাম বেড়েছে, এ কারণে অনেক সময় কম লাভ হয়। হাটের শ্রমিক বকুল হোসেন বলেন, আমরা ব্যাপারীদের গুড় টানার কাজ করি। প্রতি হাটে আয় হয় ৭০০-৮০০ টাকা মত। এ কাজ করে সংসার ভালই চলছে।তবে বর্তমান সময়ের অস্থায়ী সরোজগঞ্জ বাজার শাখা কমিটি ও জামায়েত ইসলামীর বাজার কমিটির সভাপতি মামুন হাওলাদার ও পূর্বের বাজার কমিটির সদস্য এবং জামায়েত ইসলামীর সহ সেক্রেটারি আব্দুল মালেক জানান, এ হাট থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয় গুড়। প্রতি হাটের দিন গড়ে ২৫০ টন খেজুর গুড় বিক্রি হয়। যার বিক্রয়মূল্য প্রায় ২ কোটি টাকা। সরোজগঞ্জ হাটে বিক্রি হওয়া বেশির ভাগ গুড়ই এলাকার কৃষকেরা/গাছিদের বাড়িতে যতেœর সঙ্গে তৈরি করেন। এতে চিনি বা কোনও রাসায়নিক নেই। কিছুটা খয়েরি রঙের হলেও এসব গুড় পুরোটাই খাঁটি। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বর্তমানে এ জেলায় দুই লাখ ৫০ হাজারের মতো খেজুরগাছ রয়েছে। যার প্রায় অর্ধেকই সদর উপজেলায়। প্রতি মৌসুমে গড়ে ২ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন গুড় উৎপাদিত হয়।কুতুবপুর ইউনিয়নের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ সহকারি কৃষি কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মৌসুমে প্রতিটি গাছ থেকে অন্তত ১১ কেজি গুড় পাওয়া যায়। সে হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ২ হাজার ৬ মেট্রিক টন গুড় উৎপাদিত হয়। চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জ হাট খেজুর গুড়ের প্রধান মোকাম। গুড়ের বেপারী ও গাছিরা জানিয়েছে, প্রতি বছর, বছর খেজুরের গাছগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে, খড়ি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বিভিন্ন ইটের ভাটাতে। নতুন করে কোন কৃষক বা গাছিরা খেজুর গাছ রোপণ বা লাগাচ্ছে না এছাড়াও গাছিরা জানিয়েছেন বর্তমান সময়ে গাছ কাটার লোকজন স্বল্প থাকাই এবং পূর্বে বাপ দাদারা খেজুরের গাছ কেটে আসছে, এখনকার সময়ের লোকজন খেজুর গাছ কাটছে না। যার কারণে প্রতি বছরে বছরে কমে যাচ্ছে খেজুরের গাছ কাটা, কমছে গুড় উৎপাদন। যার ফলে প্রতি কেজি গুড়ের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত। গুড় ও পাটালি উৎপাদন কম, তবে চাহিদা বেশি।
Leave a Reply