দৌলতপুর প্রতিনিধি ॥ শক্তিশালী সিন্ডিকেটের অনৈতিক চাপের মুখে অবশেষে পুলিশ প্রহরায় অফিস ত্যাগ করেছেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার রাসেল মল্লিক। বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) দিনভর জমি রেজিস্ট্রির কাজ করার পরেও আরো অর্ধশত দলিল রেজিস্ট্রির জন্য সাব-রেজিস্ট্রারকে চাপ দেন সিন্ডিকেটের প্রভাবশালীরা। কিন্তু অফিস সময় পেরিয়ে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলেও তাকে অফিস থেকে বের হতে দেয়া হয়নি। অবস্থা বেগতিক দেখে সন্ধ্যা ৭টার দিকে দৌলতপুর থানায় খবর দিয়ে পুলিশের সহযোগিতা চান সাব-রেজিস্ট্রার রাসেল মল্লিক। পরে পুলিশ প্রহরায় তিনি অফিস ত্যাগ করেন।
জানা যায়, দৌলতপুর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিসটিতে কিছুতেই অনিয়ম দুর্নীতি থামাতে পারছেন না কেউই। খোদ স্থানীয় সংসদ সদস্য সরওয়ার জাহান বাদশাহ্ হস্তক্ষেপ করেও দুর্নীতির লাগাম টানতে পারেননি। সাংসদের হস্তক্ষেপে কিছুদিন দুর্নীতির মাত্রা কমে আসলেও ফের শুরু হয় অনিয়ম দুর্নীতির মহোৎসব। সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের কতিপয় দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারী, দলিল লেখক সমিতি ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এখানকার জমি রেজিস্ট্রির কাজ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে নানামুখী হয়রানি, ভোগান্তি আর আর্থিক অপচয়ের সম্মুখিন হচ্ছেন জমি রেজিস্ট্রি করতে আসা সাধারণ মানুষজন।
একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, এবারের সিন্ডিকেট গড়তে দলিল লেখকদের দুই গ্রুপ নিজেদের স্বার্থেই একত্রিত হয়ে যায়। দুই গ্রুপের দুই নেতা অঘোষিত এই সিন্ডিকেট সদস্য হন। উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের প্রধান অফিস সহকারী জান্নাতুন ফেরদৌস মুন্নি এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা। মুন্নির নেতৃত্বে দলিল লেখক সমিতির সভাপতি মাহাতাব উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক আরজ উল্লাহ এবং ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় এই শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তারা দলিল প্রতি ১ হাজার ৬শ টাকা করে আদায় করছেন। যা সরকার নির্ধারিত খরচের কয়েকগুণ বেশি। এছাড়া জমি রেজিস্ট্রিতে অপরিহার্য টিপ সই নেয়ার ক্ষেত্রেও একেকজনের কাছ ১৫০ টাকা করে আদায় করা হয়। বিপুল অঙ্কের এই টাকা জমা পড়ে প্রধান অফিস সহকারী জান্নাতুন ফেরদৌস মুন্নির হাতে। সেখান থেকে সরকারি খরচ বাদে বাকি টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নেন তারা। স্থানীয় কতিপয় সাংবাদিকের নামেও এই টাকার একটি অংশ বরাদ্দ দেয়া হয় বলে সূত্রগুলো জানায়। তবে বেশ কয়েকজন পেশাদার সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হলে তারা এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন।
অন্যদিকে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে জমি রেজিস্ট্রি করতে আসা সাধারণ মানুষজন সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে নানামুখী হয়রানি, ভোগান্তি আর আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়ে আসছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সমময়েও বাড়তি টাকা গুনতে তারা অপারগতা প্রকাশ করলেও তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে সিন্ডিকেটের নির্ধারণ করা বাড়তি টাকা দিয়েই তাদের জমি রেজিস্ট্রি করতে হচ্ছে। দৌলতপুর আসনের সংসদ সদস্য সরওয়ার জাহান বাদশাহ্ নির্বাচিত হওয়ার পর জমি রেজিস্ট্রিতে মানুষের কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায় বা অনিয়ম দুর্নীতি বন্ধে হস্তক্ষেপ করায় এমপির ভয়ে প্রথমের দিকে দুর্নীতির মাত্রা কিছুটা কমে যায়। কিন্তু কয়েক মাস যেতে না যেতেই ফের শুরু হয় দুর্নীতির মহোৎসব।
দলিল লেখক সমিতির দুই গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্ব চলে আসলেও নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাই অনিয়ম দুর্নীতিতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন। জমি রেজিস্ট্রির জন্য আসা মানুষজনকে জিম্মি করে বাড়তি টাকা আদায়ের পর সেইসব টাকা তুলে দেয়া হয় সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের প্রধান অফিস সহকারী জান্নাতুন ফেরদৌস মুন্নির হাতে। পরে তা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়া হয়। আর এখন দলিল লেখকদের দুই গ্রুপ এক হয়ে যাওয়ায় শুরু হয়েছে তাদের লাগামহীন অবৈধ কর্মকাণ্ড।
প্রধান অফিস সহকারী জান্নাতুন ফেরদৌস মুন্নির নেতৃত্বে গঠিত শক্তিশালী সিন্ডিকেটের অনৈতিক কর্মকান্ডের কারণে ইতোমধ্যে পরপর তিনজন সাব-রেজিস্ট্রার এখান থেকে স্বেচ্ছায় বদলি হয়ে চলে গেছেন। কারণ তারা এসব অবৈধ কর্মকান্ডের দেননি। সবশেষ মিরপুর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার রাসেল মল্লিককে দৌলতপুরে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে সপ্তাহে দুই দিন জমি রেজিস্ট্রির কার্যক্রম চালানো হচ্ছিল। কিন্তু শক্তিশালী সিন্ডিকেটের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কাছে তিনিও অসহায় হয়ে পড়েন। মাত্র তিন সপ্তাহের মাথায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সাব-রেজিস্ট্রার রাসেল মল্লিক পুলিশ প্রহরায় অফিস ত্যাগ করেন। দৌলতপুর থানার সেকেন্ডড অফিসার এসআই অরুণ কুমার সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে তাকে অফিস থেকে নিরাপদে সরিয়ে নেন।
সিন্ডিকেটের তৎপরতার কথা স্বীকার করে উপজেলা রেজিস্ট্রার অফিসের প্রধান অফিস সহকারী জান্নাতুন ফেরদৌস মুন্নি মোবাইল ফোনে বলেন, এখানকার পরিবেশ দিন দিন খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমি নিজেও বদলি হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। জমি রেজিস্ট্রিতে কয়েক গুণ বাড়তি টাকা ও সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূতভাবে টিপ সইয়ে ১৫০ টাকা করে আদায় করা প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আপনি অফিসে আসেন সরাসরি কথা বলবো। তার আমন্ত্রণ নাকচ করে দেয়া হলে তিনি দলিল লেখক সমিতির নেতাদের (সিন্ডিকেট সদস্য) সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করেন।
সিন্ডিকেটের অনৈতিক চাপের মুখে পুলিশের প্রহরায় অফিস ত্যাগকারী দৌলতপুর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার রাসেল মল্লিকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। দৌলতপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নাসির উদ্দিন বলেন, আমি নির্বাচনী ডিউটিতে আছি। সাব-রেজিস্ট্রারের নিরাপত্তাহীনতার এই বিষয়টি আমার জানা নেই।
Leave a Reply